পুরুষ তু‌মি পুরুষ হও

পুরুষ তু‌মি পুরুষ হও

– সাইফুদ্দিন গাজী

প্রথম মানুষ প্রথম পুরুষ। এ পুরুষ থে‌কেই সমস্ত মানু‌ষের সৃ‌ষ্টি। মানু‌ষের সম্মান মর্যাদা মূলত পুরু‌ষের মাধ্য‌মে। আল্লাহ পাক যে মান‌বের সম্মা‌নে ফে‌রেশতা‌দেরকে সেজদা কর‌তে ব‌লে‌ছেন, তি‌নি ছি‌লেন পুরুষ। যে মানব‌কে খেলাফত দি‌বেন ব‌লে সৃ‌ষ্টি ক‌রে‌ছেন, তি‌নি ছি‌লেন পুরুষ। তার মা‌নে, শ্রেষ্ঠ‌ত্বের মুকুট এবং খেলাফ‌তের সিংহাসন সবই পুরু‌ষের জন্য। অ‌ন্যেরা তার সহকারী ও সহ‌যোগী। তার সহ‌যোগিতার জন্য তারই অর্ধাঙ্গীনী হিসা‌বে নারী‌কে সৃ‌ষ্টি করা হ‌য়ে‌ছে তাঁর বাম পাঁজ‌রের হাঁড় থে‌কে। সম্ভবত এ‌তে পুরু‌ষের স্বাতন্ত্র্যতা ও নারীর অধীনতার ই‌ঙ্গিত র‌য়ে‌ছে।

পুরুষ আল্লাহর প্র‌তি‌নিধি, জগ‌তের অ‌ভিভাবক। এ গুরু দা‌য়িত্ব পাল‌নের নি‌মিত্ত পুরুষের ব্য‌ক্তিত্বগঠ‌নের জন্য যা যা প্র‌য়োজন, তা তি‌নি পুরু‌ষের মধ্যে গ‌চ্ছিত রে‌খে‌ছেন; যা তি‌নি নারী‌কে দেন‌নি। পৃ‌থিবীর ক‌ঠিন থে‌কে দা‌য়িত্বগু‌লো পুরু‌ষের স্ক‌ন্ধে। পুরুষ নবী-রাসূল, শাসক, যোদ্ধা, চালক-প‌রিচালক সবই । পুরু‌ষের সৃ‌ষ্টি‌কৌশল, স্বভাবপ্রকৃ‌তি সে দা‌য়িত্বের উপ‌যোগী ক‌রে তৈ‌রি করা হ‌য়ে‌ছে। ‘আক‌লে কা‌মেল’, ‘জিস‌মে কাভী’ তথা পূর্ণ বিবেকবু‌দ্ধি, শক্ত দেহকাঠা‌মো ইত্যা‌দি সবই তার দা‌য়িত্ব ও ব্য‌ক্তি‌ত্বের সা‌থে সম‌ন্বিত। তার দে‌হের ব‌হিঃআকৃ‌তিও ‌সেভা‌বেই সুস‌জ্জিত করা হ‌য়ে‌ছে। 
পুরুষ হ‌লো ব‌হির্বান্ধব, আর নারী হ‌লো ঘরবান্ধব। পুরু‌ষের প্রধান কর্ম‌ক্ষেত্র বাই‌র, প্র‌য়োজ‌নে ঘ‌রে। আর নারীর প্রধান কর্ম‌ক্ষেত্র গৃহ, প্র‌য়োজ‌নে বাই‌রে। 
বস্তুত নারীর সা‌থে পুরু‌ষের ‌দৈ‌হিক মান‌সিক, বা‌হ্যিক ও আভ্যন্তরীন পার্থক্যগু‌লো সুস্পষ্ট। এ পার্থক্য যারা অস্বীকার করে, কিংবা মান‌তে নারাজ; তারা মূলত প্রকৃ‌তি‌বি‌রোধী এবং সৃ‌ষ্টি‌বিকৃ‌তিকারী। তারাই জগ‌তে বিশৃঙ্খলাকারী।

নারী-পুরু‌ষের একজ‌নের স্থ‌লে আ‌রেকজন‌কে রি‌প্লেস করা, কিংবা একজন অপরজ‌নের বেশভুষা ধারণ করা জাগ‌তিক বহু বিশৃঙ্খলার কারণ। এ‌টি বহু সামা‌জিক, পা‌রিবা‌রিক ও নৈ‌তিক সমস্যা ও অশা‌ন্তি সৃ‌ষ্টির অন্যতম উপকরণ। যে ঘ‌রের কর্তা কার্য‌ক্ষে‌ত্রে নারী, ‌দেখ‌বেন সেঘ‌রে সমস্যার অন্ত নেই। বর্তমান বহু সমস্যার মূল কারণ এ অ‌নৈ‌তিক রি‌প্লেস‌মেন্ট।

পুরুষ‌কে জগতশাসনের নি‌মিত্ত আল্লাহ তাআলা তা‌কে যে বাহ্য পোষাক ও ইউ‌নিফর্ম দি‌য়ে‌ছেন; তা‌তে দাড়ি র‌য়ে‌ছে। দা‌ড়ি পুরু‌ষের মুখশ্রী ও ব্য‌ক্তি‌ত্বের প্রকাশ। দা‌ড়ি পুরু‌ষের পৌরষ‌শোভা ও শ্রেণীগত ল‌গো। দা‌ড়ি পুরু‌ষের মু‌খেরফুল, যেম‌নি নারীর জন্য তার মাথার চুল। চুলহীন নারী যেমন অসুন্দর, দা‌ড়িহীন নর তেম‌নি। নর যখন দা‌ড়ি মুন্ডন ক‌রে, তখন সে নারীর সৌন্দর্য ও কম‌নিয়তা লাভ ক‌রে ঠিকই, কিন্তু সে পুরুষসুলভ ব্যক্তিত্ব ও গা‌ম্ভির্য হারি‌য়ে ফে‌লে। এ‌তে ক‌রে নর হ‌য়ে যায় নারীর ম‌তো। নারী নর‌কে হা‌তের মু‌ঠোয় নি‌য়ে আ‌সে।

এজন্য নারী যেমন তার চুল মুণ্ডন করা হারাম, তেম‌নি পুরুষ তার দা‌ড়ি মুন্ডন করা হারাম। মাসআলাগত ভা‌বে নারীর চুল ও পুরু‌ষের দা‌ড়িফুল একই সমান। কিন্তু অ‌ধিকাংশ মানুষ এখ‌নো পর্যন্ত নারীর দীর্ঘচুল‌কে শোভা ম‌নে কর‌লেও দুঃখজনকভা‌বে অ‌ধিকাংশ নরনারী পুরু‌ষের দীর্ঘ দা‌ড়ি‌কে সেরকম ম‌নে ক‌রে না। বরঞ্চ অপরাধ ম‌নে ক‌রে। দা‌ড়িমুন্ডন‌কে এখন যু‌গের ফ্যাশন ম‌নে করা হয়। অথচ এ‌তে নারীর সা‌থে পুরু‌ষের দৃশ্যমান পার্থক্য অ‌নেকটা মু‌ছে যায়।

একসময় পুরুষমাত্রই দা‌ড়ি রাখ‌তো। দা‌ড়ি ছিল পুরু‌ষের প্রতীক, চাই সে যে ধ‌র্মের অনুসারীই হোক না কেন। ইসলাম পুরু‌ষকে যে প্রাকৃ‌তিকতার ওপর বহাল থাক‌তে ব‌লে‌ছে। ‌কিন্তু সেটা এখন হ‌য়ে গে‌ছে কেবল ধর্মীয় প্রতীক। ধর্মানুরাগী ও আ‌লিম উলামা‌দের ভূষ‌ণ। অ‌ধিকাংশ পুরুষ সে স্বভাবপোষাক‌কে হা‌রি‌য়ে ফে‌লেছে। মান‌বে‌তিহা‌সে যখন থে‌কে পুরু‌ষের মুখশ্রী‌তে দা‌ড়ি সং‌জো‌যিত হ‌য়ে‌ছিল, তখন থে‌কে ফরাসী বিপ্ল‌ব ও প‌শ্চিমা সংস্কৃ‌তিক বিকৃ‌তির আগ পর্যন্ত পুরুষমাত্রই দা‌ড়ি রাখ‌তো। বিশ্বাস না হয় প্রাচীন ইতিহাস ও শিলা‌মূ‌র্তিগু‌লো দেখুন। মরহুম অধ্যাপক মাওলানা আখতার ফারূক সা‌হেব লি‌খে‌ছেন, বিপ্ল‌বোত্তর যখন প‌শ্চি‌মের পুরু‌ষেরা দাড়ি মুন্ডা‌তে শুরু কর‌লো, তখন দা‌ড়ির প‌ক্ষে প্যা‌রি‌সের রাস্তায় মে‌য়েরা মি‌ছিল বের ক‌রে‌ছিল। শ্লোগান ছিল “দা‌ড়ি কাটা চল‌বে‌ না…, দা‌ড়ির পেলব পরশ থে‌কে ব‌ঞ্চিত করা চল‌বে না…।”
‌কিন্তু যে‌ বিপ্লব মানু‌ষের স্বভাবপ্রকৃ‌তির সা‌থে সামঞ্জস্যশীল নয়, সেটা পুরু‌ষের দা‌ড়ি রক্ষা কর‌বে কীভা‌বে? ‌বিপ্ল‌বের প্রবল বাতা‌সে প‌শ্চিমা পুরু‌ষের মুখ থে‌কে দা‌ড়ি গেল উ‌ড়ে।
ক্রমশ ‌বৈবর্তি‌নিক ধারায় আরও বিকৃ‌তি আস‌তে থাক‌লো। মে‌য়েরা এখন পুরুষ ও শাসক চায় না, চায় কেবল বন্ধু। আত্মমর্যাহীন পুরুষও এখন নারীর অ‌ভিভাবক হ‌তে চায় না, চায় কেবল বন্ধু হ‌তে। সা‌থে বৃ‌দ্ধি পে‌য়ে‌ছে পুরু‌ষের ম‌ধ্যে কাওমে লু‌তের বদঅভ্যাস। পুরুষ নারীর ম‌তো ব্যবহৃত হ‌তে চায়; যার জন্য ক্লিন‌সেভ মানানসই। ফ‌লত চা‌রি‌দিক এখন নারীময়। নারী পুরুষ উভ‌য়ের চা‌হিদা মোকা‌বেক উভয়ই এখন বন্ধু বন্ধু। এ‌ক্ষে‌ত্রে নারী তো তার আস‌নে মোটা‌মো‌টি ঠিকই র‌য়ে‌ছে, বরঞ্চ পুরু‌ষের অ‌নেক আসনও দখল নি‌য়ে‌ছে; কিন্তু পুরু‌ষের হ‌য়ে‌ছে অধঃগ‌তি। পুরুষ হা‌রি‌য়ে‌ছে তার সম্মান ও সিংহাসন। তার আ‌ভিজাত্য ও আত্মমর্যাদা। তার নিজস্ব ভূষণ ও ফ্যাশন। ‌সে এখন দেখ‌তে নারী নারী! 

ফ‌লে সে এখন নারীর পুডুল। নারীর হাজ‌বেন্ড না হ‌য়ে হ‌য়ে গে‌ছে সার‌ভেন্ট। প্রভু না হ‌য়ে হ‌য়ে গে‌ছে ভৃত্য। এখন নারীরা পুরু‌ষের নাম ধ‌রে ডা‌কে। তুই-তোক্কারী ক‌রে কথা ব‌লে। গা‌লে জোর‌সে থাপ্পর মা‌রে। মা‌ঝে মা‌ঝে কানডলাও দেয়। নর এখন নারীর ভাঁড় ও ভেড়ায় প‌রিণত হ‌য়ে‌ছে। অথচ স্রষ্টার নিয়ম অনুসা‌রে পুরুষ নারীর শুধু বন্ধুই নয়, সে তা‌দের অ‌ভিভাবকও। আ‌গেও বলা হ‌য়ে‌ছে, পুরুষ শুধু নারীর অ‌ভিভাবক নয়, পু‌রো জগ‌তের অ‌ভিভাবক। জগতসংসা‌রের প্র‌য়োজ‌নে পুরু‌ষের পৌরষ ও ব্য‌ক্তিত্ব অক্ষুণ্ন রাখা জরু‌রি।

আধু‌নিক সমাজব্যবস্থায় এ‌ক্ষে‌ত্রে যা হ‌চ্ছে, তা সুস্পষ্ট রু‌চি‌বিকৃ‌তি ও সৃ‌ষ্টি‌বিকৃ‌তি। কুরা‌আ‌নে এটা‌কে শয়তা‌নের কুকর্ম ব‌লে উ‌ল্লেখ করা হ‌য়ে‌ছে। হাদীস শরী‌ফে এ‌দের‌কে অ‌ভিসম্পাত করা হ‌য়ে‌ছে। নারীত্বহীন নারী এবং পৌরষহীন পুরুষ অ‌ভিশপ্ত। পুরু‌ষের বেশধারী নারী, নারীর বেশধারী পুরুষ অ‌ভিশপ্ত। উভয়‌কে প‌রিশুদ্ধি অর্জন কর‌তে হ‌বে। পুরুষ তার পুরুষসুলভ স্বভাব জাগ্রত কর‌তে হ‌বে। আপন শ‌ক্তি‌তে জে‌গে উঠ‌তে হ‌বে। হীনন্মন্যতা কে‌টে সাহ‌সী ভূ‌মিকায় অবতীর্ণ হ‌তে হ‌বে। তার পুরুষসুলভ ইউ‌নিফর্ম আবার পর‌তে হ‌বে। তার শাস‌কের সিংহাসন পুনরুদ্ধার কর‌তে হ‌বে। ভীরু নয়, বী‌রের ভূ‌মিকায় অবতীর্ণ হ‌তে হ‌বে। পুরুষের শোভা, পৌর‌ষের মুকুট গলায় দা‌ড়িফু‌লের মালা আবার পর‌তে হ‌বে। নারী য‌দি আস‌লে পুরু‌ষের স্বাদ পে‌তে চায়, প্রকৃত পুরু‌ষের সৌন্দর্য দেখ‌তে চায়, তা হ‌লে তা‌কে তার কর্তৃত্ববা‌দিতা ছাড়‌তে হ‌বে। তার দৃ‌ষ্টিভ‌ঙ্গিতা বদলা‌তে হ‌বে এবং পুরুষ‌কে আপনরূ‌পে ফি‌রে আসার জোর দাবী জানা‌তে হ‌বে। প্রকতপুরুষ‌কে ভা‌লোবাস‌তে হ‌বে এবং এ‌দের‌কে সাদ‌রে বরণ করে নি‌তে হ‌বে।

বস্তুত দা‌ড়ি পুরু‌ষের শোভা , পৌর‌ষের দী‌প্তি। বুদ্ধির প‌রিপক্কতা ও রম‌ণের লক্ষণ। নারী ও নাবা‌লে‌গের কখ‌নো দা‌ড়ি হয় না।

দা‌ড়ি সম্মা‌নের প্রতীক, শাস‌কের মুকুট। শ্রেষ্ঠ‌তের পতাকা, বীর‌ত্বের বর্ম। 

দা‌ড়ি বিশুদ্ধ রু‌চির প‌রিচায়ক, স্বভাব-প্রকৃতির বিধায়ক। 
দা‌ড়িওয়ালা পুরুষ আসল পুরুষ, সুপুরুষ। দা‌ড়িহীন পুরুষ আধাপুরুষ, বিকৃত পুরুষ অথবা ননপুরুষ। 
দা‌ড়ি মহামান‌বের ভুষণ। কো‌নো নবী রাসূল বা ধর্মগু‌রু, কো‌নো জ্ঞানী-মহাজ্ঞানী দা‌ড়িমুন্ডন ক‌রেন‌নি; এ বিকৃত আধু‌নিক যুগ ছাড়া।

ভাগ্যবান ওই যুবক, ‌যে পৌর‌ষের এ দী‌প্তি হারায়‌নি, পুরুষ‌ত্বের এ প্রতীক খোয়ায়‌নি। তার সম্মান ও সিংহাসনও হাতাছাড়া ক‌রেনি। ধন্যবাদ তা‌কে, সাধুবাদ সেই সিংহপুরুষ‌কে।

কা‌জেই, এ‌সো হে পুরুষ এ‌সো! 
আমরা পুরুষ হই! সুপুরুষ। আসল পুরুষ। প্রকৃত পুরুষ। শ্রেষ্ঠ পুরুষ! পৌর‌ষে মোরা ধন্য ক‌রি এ জগত ভুবন‌কে! তা হ‌লেই কর্ম‌ক্ষে‌ত্রে ও সর্ব‌ক্ষে‌ত্রে সুপুরু‌ষের প্র‌তি বৈষম্য বন্ধ হবে। আড়ং‌দের ভড়ং রুদ্ধ হ‌বে। বন্ধ হবে নপুংসক‌দের রাজ! ফিরে পা‌বে আসল পুরু‌ষ তার স্বরাজ! 

সুতরাং তু‌মি পুরুষ হও হে বন্ধু, পুরুষ!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *