– খাইরুল ইসলাম
একজন মুসলিম হিসেবে আমরা নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করি এবং করতে হয়। কিন্তু অনেক সময় না-জানা বা অবহেলার কারণে আমাদের নামাযে বিভিন্ন ধরনের ভুল হয়ে যায়। সেসব ভুল-ত্রুটির দরুন কখনো নামায মাকরূহ হয়ে যায়, আবার কখনো নামাযই হয় না; বিলকুল নষ্ট হয়ে যায়। সব ধরনের ভুল-ত্রুটি সম্পর্কে তো এখানে আলোচনা করা মুশকিল। তাই এখানে বহুল প্রচলিত কতিপয় মারাত্মক পর্যায়ের ভুল-ভ্রান্তি সম্পর্কে আলোচনা করছি, যেসব ভুলের কারণে নামাযই হয় না।
১. তাকবীরে তাহরীমা মনে মনে বলা :
অনেকে নামাযের শুরুতে উভয় হাত কান পর্যন্ত উঠিয়ে বাঁধাকেই তাকবীরে তাহরীমা বলে মনে করে। ফলে তারা আর মুখে তাকবীর উচ্চারণ করে না। কেবল হাত উঠিয়ে বাঁধার উপরই ক্ষান্ত করে। এটি একটি মারাত্মক ভুল। এর দ্বারা নামায সহীহ হয় না। কারণ নামাযের শুরুতে স্পষ্ট উচ্চারণে তাকবীর তথা ‘আল্লাহু আকবার’ বলা ফরয। যেহেতু এই তাকবীরের মাধ্যমে নামায বহির্ভূত সকল কাজ হারাম হয়ে যায় তাই একে ‘তাকবীরে তাহরীমা’ বলা হয়। এই তাকবীর স্পষ্টভাবে মুখে উচ্চারণ করে বলা ফরয।
সুতরাং কেউ যদি শুধু দু’হাত উঠিয়ে নাভির নিচে বেঁধে নেয়; কিন্তু মুখে ‘আল্লাহু আকবার’ না বলে বা মনে মনে বলে তাহলে তার নামাযের প্রথম ফরযটি আদায় না হওয়ার কারণে তার নামায সহীহ হবে না। অতএব তাকবীর স্পষ্টভাবে মুখে উচ্চারণ করতে হবে। শুধু মনে মনে বলা যথেষ্ট হবে না। -মারাকিল ফালাহ পৃ. ২১৮; রদ্দুল মুহতার ১/৪৫২
২. ইমামের আগে তাকবীরে তাহরীমা শেষ করে ফেলা :
অনেক মুসল্লীকে দেখা যায়, তারা ইমামের সাথে তাকবীরে উলা ধরার জন্য একেবারে ইমামের সাথে সাথেই তাকবীরে তাহরীমা বলে। এক্ষেত্রে অসতর্কতার দরুন কখনো কখনো মুক্তাদির নামায অশুদ্ধ হয়ে যায়। কেননা মুক্তাদির নামায শুদ্ধ হওয়ার জন্য তার তাকবীরে তাহরীমা, ইমামের তাকবীরে তাহরীমা বলা শেষ হবার পরে শেষ হওয়া জরুরি। ইমামের তাকবীরে তাহরীমা শেষ হওয়ার পূর্বেই যদি মুক্তাদির তাকবীর বলা শেষ হয়ে যায় তাহলে তার ইক্তেদা ও নামায সহীহ হবে না।
অনেক সময় ইমাম সাহেবের তাকবীরে তাহরীমা দীর্ঘ করে টেনে বলার কারণে মুক্তাদির তাকবীর তার আগে শেষ হয়ে যায়। ফলে মুক্তাদির নামায শুদ্ধ হয় না। অতএব মুক্তাদিদেরকে এ ভুল থেকে বাঁচানোর জন্য ইমামের কর্তব্য হলো, তাকবীরে তাহরীমা-এর ‘আল্লাহ’ শব্দের লামকে এক আলিফের চেয়ে বেশি দীর্ঘ না করা। -আদ্দুররুল মুখতার ১/৪৮০
৩. আল্লাহু আকবার এর ‘হামযা’ অথবা ‘বা’ কে টেনে পড়া:
কোনো কোনো মুসল্লী ও ইমামকে নামাযের মধ্যে তাকবীর বলার সময় ‘আল্লাহু আকবার’ এর (বা) টেনে পড়তে শোনা যায়। এটা একটা বড় ভুল। কারণ (বা) এ ‘মাদ্দ’ করলে অর্থাৎ টেনে দীর্ঘ করে পড়লে তার অর্থে চরম বিকৃতি ঘটে। বিনা মাদ্দে ‘আকবার’ অর্থ ‘সবচেয়ে বড়’। আর মাদ্দ সহকারে ‘আকবা-র’ শয়তানের বাচ্চার নাম। এ ভুলটি যদি তাকবীরে তাহরীমার মধ্যে হয় তাহলে নামায আরম্ভই হবে না। আর নামাযের ভিতরের কোনো তাকবীরে হলে নামায নষ্ট হয়ে যাবে। তদ্রূপ ‘আল্লাহু আকবার’ এর প্রথম অথবা দ্বিতীয় ‘আ’-কে টেনে দীর্ঘ করে পড়লে নামায ভেঙ্গে যাবে। কেননা সেক্ষেত্রেও তাকবীরের অর্থ ও মর্ম ভীষণভাবে পাল্টে যায়। সেক্ষেত্রে তা প্রশ্নবোধক বাক্যে পরিণত হয়, যা আল্লাহ তাআ’লার বড়ত্ব ও মহত্ত্বে সংশয় প্রকাশ করে। -মারাকিল ফালাহ পৃ. ২২৩; রদ্দুল মুহতার ১/৪৮০
৪. মনে মনে কেরাত পড়া :
যে সকল নামাযে আস্তে কেরাত পড়া হয়, সেসব নামাযে অনেককে দেখা যায়, তারা মুখ-ঠোঁট না নেড়ে মনে মনে সূরা কেরাত পড়েন। তারা হয়তো মনে করেন যে, আস্তে কেরাত পড়া মানে মনে মনে পড়া। এই ধারণা ঠিক নয়। কারণ নামাযে কেরাত আস্তে পড়ার অর্থ হলো, নিচু স্বরে তেলাওয়াত করা। আর মনে মনে পড়া কোনোক্রমেই নিম্নস্বরে পড়া নয়।
আস্তে কেরাত পড়ার সর্বোত্তম পদ্ধতি হলো এমনভাবে পড়া, যেন পাঠকারী নিজে শুনতে পায়। আর সর্বনিম্ন এতটুকু তো অবশ্যই জরুরি যে, সহীহ-শুদ্ধভাবে হরফ উচ্চারণ করা হবে এবং ঠোঁট-জিহবার নড়াচড়া দেখা যাবে। হাদীস শরীফে আছে যে, যোহর ও আসর নামাযে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কেরাত পড়তেন, তখন কোনো কোনো আয়াত সাহাবায়ে কেরামও কখনো কখনো শুনতে পেতেন।
হযরত আবূ কাতাদা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন-
أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم كَانَ يَقْرَأُ بِأُمِّ الْكِتَابِ وَسُورَةٍ مَعَهَا فِي الرَّكْعَتَيْنِ الأُولَيَيْنِ مِنْ صَلاَةِ الظُّهْرِ وَصَلاَةِ الْعَصْرِ، وَيُسْمِعُنَا الآيَةَ أَحْيَانًا
‘নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যোহর ও আসর নামাযের প্রথম দু’রাকাতে সূরা ফাতেহার সাথে আরেকটি সূরা পড়তেন। কখনো কোনো কোনো আয়াত আমাদের শুনিয়ে পড়তেন।’ -সহীহ বুখারী, হাদীস : ৭৭৮
তাবেয়ী আবু মামার রহ. বলেন, আমরা হযরত খাববাব রা.কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি যোহর ও আসর নামাযে কেরাত পড়তেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আমরা প্রশ্ন করলাম, আপনারা কীভাবে বুঝতেন? তিনি বললেন-
بِاضْطِرَابِ لِحْيَتِهِ.
‘তাঁর দাঁড়ি মোবারকের নড়াচড়া দ্বারা।’ -সহীহ বুখারী, হাদীস : ৭৪৬
অতএব কেরাত পড়ার সময় জিহবা ও ঠোঁট ব্যবহার করে মাখরাজ থেকে সহীহ-শুদ্ধভাবে হরফ উচ্চারণ করতে হবে। অন্যথায় শুধু মনে মনে পড়ার দ্বারা কেরাত আদায় হবে না এবং নামাযও সহীহ হবে না। -মারাকিল ফালাহ পৃ. ২১৯; রদ্দুল মুহতার ১/৪৫২
৫. রুকুতে গিয়ে তাকবীরে তাহরীমা বলা শেষ করা :
অনেকে জামাতে ইমাম সাহেবকে রুকু অবস্থায় পেলে রাকাত ধরার জন্য দ্রুত রুকুতে চলে যায়। এ ক্ষেত্রে অনেকেই তাকবীরে তাহরীমা রুকুতে গিয়ে বলে। আবার অনেকে পূর্ণ তাকবীর রুকুতে গিয়ে না বললেও দাঁড়িয়ে তাকবীর শুরু করে, কিন্তু শেষ করে রুকুতে গিয়ে। অর্থাৎ দাঁড়ানো অবস্থায় ‘আল্লাহু’ বলে আর রুকু অবস্থায় গিয়ে ‘আকবার’ বলে। এটা একটা বড় ভুল। এভাবে তাকবীরে তাহরীমা বললে নামায হবে না। বরং পুরো তাকবীরে তাহরীমা দাঁড়িয়ে বলা জরুরি। পূর্ণ তাকবীর কিংবা তাকবীরের কিছু অংশও যদি রুকুতে গিয়ে [অর্থাৎ হাত হাঁটু পর্যন্ত পৌঁছার পর] বা তার কাছাকাছি গিয়ে শেষ হয় তাহলে নামায হবে না। অবশ্য দাঁড়ানোর কাছাকাছি থাকা অবস্থায় পূর্ণ তাকবীরে তাহরীমা বলা শেষ করলেও নামায হয়ে যাবে।
অতএব তাকবীরে তাহরীমা পুরোটাই দাঁড়ানো বা দাঁড়ানোর কাছাকাছি অবস্থার ভেতর বলে শেষ করতে হবে। -খুলাসাতুল ফাতাওয়া ১/৮৪; আলমুহীতুল বুরহানী ২/৩৭; খুলাসাতুল ফাতাওয়া ১/৮৪; ফাতাওয়া খানিয়া ১/৮৭; ফাতহুল কাদীর ১/২৪৩; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ১/৪৪১; মারাকিল ফালাহ, পৃ. ১১৮; আদ্দুররুল মুখতার ১/৪৮০; আসসিআয়াহ ২/১১০
৬. ইমামের রুকু থেকে উঠার পর রুকুতে যাওয়া :
কোনো কোনো সময় এমন হয় যে, জামাত চলাকালীন আগন্তুক মুসল্লী তাকবীরে তাহরীমা বলে রুকুতে যাচ্ছে আর এদিকে ইমাম সাহেব ‘সামিআল্লাহ’ বলে রুকু থেকে উঠে গেছেন। এক্ষেত্রে উক্ত মুসল্লী ইমামের সাথে রুকু না পাওয়ার কারণে ঐ রাকাত পায়নি। কেননা রাকাত পাওয়ার জন্য ইমামের সাথে রুকু পাওয়া জরুরি। আর রুকু পাওয়ার জন্য এক মুহূর্তের জন্য হলেও ইমামের সাথে রুকুতে শরিক হওয়া আবশ্যক। যদি কেউ ইমামকে রুকু অবস্থায় এক মুহূর্তের জন্যও না পায়; বরং ইমামের রুকু থেকে উঠে যাওয়ার পর, অর্থাৎ তার মাথা এবং হাঁটু থেকে হাত উঠে যাওয়ার পর রুকুতে যায় তাহলে সে ওই রাকাত পেয়েছে বলে ধর্তব্য হবে না।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন-
إِذَا أَدْرَكتَ الْإِمَامَ رَاكِعًا فَرَكَعْتَ قَبْلَ أَنْ يَرْفَعَ فَقَدْ أَدْرَكْتَ، وَإِنْ رَفَعَ قَبْلَ أَنْ تَرْكَعَ فَقَدْ فَاتَتْكَ.
‘তুমি যদি ইমামকে রুকুতে পাও এবং ইমাম রুকু থেকে ওঠার আগে তুমিও রুকুতে চলে যাও তাহলে তুমি রাকাত পেয়েছ বলে গণ্য হবে। কিন্তু তুমি রুকুতে যাওয়ার আগেই যদি ইমাম রুকু থেকে উঠে যান তবে তুমি এই রাকাত পাওনি।’ -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, বর্ণনা: ৩৩৬১
কিন্তু অনেক মুসল্লী ইমাম সাহেবের রুকু থেকে উঠে যাওয়ার পর রুকুতে গিয়ে সেই রাকাত পেয়েছে বলে ধারণা করে এবং এক রাকাত কম আদায় করে। এতে তার নামায হয় না।
মুসল্লীদের এই মারাত্মক ভুল থেকে রক্ষার জন্য ইমাম সাহেবদের উচিত হলো, রুকু থেকে উঠা আরম্ভ করতেই তাকবীর বলা শুরু করা। কেননা কোনো কোনো ইমাম সাহেব রুকু থেকে উঠার সময় কিছুদূর উঠার পর তাকবীর বলেন। ফলে নবাগত মুসল্লী দূর থেকে মুসল্লীদেরকে রুকু অবস্থায় দেখে তাকবীরে তাহরীমা বলে রুকুতে যায়। অথচ তখন ইমাম সাহেব রুকু অবস্থায় নেই। এতে সে ইমামের সাথে রুকু পেয়েছে মনে করে সে হিসেবে নামায পড়ার দরুন তার নামায বাতিল হয়ে যায়। -মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, হাদীস: ২৫৩৭-২৫৩৭; আলমাবসূত, সারাখসী ২/৯৪; আলমুহীতুল বুরহানী ৩/১১৯; ফাতহুল কাদীর ১/৪২০; শরহুল মুনইয়া, পৃ. ৩০৫; হালবাতুল মুজাল্লী ২/১২৬; আদ্দুররুল মুখতার ২/৬০; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১২০
৭. প্রথম সালামের পর ইমামের ইক্তেদা করা :
অনেককে দেখা যায়, শেষ বৈঠকে যখন ইমাম সাহেব ডানদিকে সালাম ফিরিয়ে ফেলেন তখনও তারা তার ইক্তেদা করেন। এটাও ঠিক নয়। কারণ প্রথম সালামের ‘আসসালামু’ শব্দটি বলার সাথে সাথেই ইমামের ইক্তেদার সময় শেষ হয়ে যায়। এরপর আর ইমামের ইক্তেদা করা সহীহ নয়। সুতরাং এ অবস্থায় মুসল্লী ইমামের ইক্তেদা করলে তার নামায আদায় হবে না। -হাশিয়াতুত তাহতাবী আলাল মারাকী পৃ. ২৫১; রদ্দুল মুহতার ১/৪৬৮, ৫২৫
আল্লাহপাক আমাদেরকে সব ধরনের ভুল থেকে বেঁচে থেকে সুন্দর ও সঠিকভাবে নামায আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমীন।